আসলে কী ঘটেছিলো ৫ই মে, ২০১৩ শাপলা চত্বরে?




কনটেক্সট - ২০১৩ সাল। সংসদে বিএনপি, জামাত আছে। রাজপথে বিএনপি জামাত আছে। বিএনপি, জামাতপন্থী মিডিয়া হাউজ আছে। শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া লোক আছে। ২০১০ সালে জন্ম নেয়া সরকারী নারীনীতি বিরোধী কওমী মাদ্রাসার সংগঠন হেফাজতে ইসলাম হঠাৎ করে নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনে নেমেছে।

হেফাজতের নাস্তিকবিরোধী অবস্থানকে দৃঢ় করে দেয় আমার দেশ পত্রিকার মাহমুদুর রহমান, বিএনপি সরকাররের জ্বালানী মন্ত্রী/উপদেষ্টা। স্থপতি রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয় শাহবাগ আন্দোলন শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই। আমার দেশ পত্রিকা রাজীব হায়দারের ব্লগের লেখা বের করে আনেন যে তিনি নাস্তিক ছিলেন। সুতরাং শাহবাগের সকলেই নাস্তিক। ওদের দাবিও আলেম ওলামাদের মৃত্যুদণ্ড!! টেকনিকটা চিনেছেন? আবু সাঈদ জামাতপন্থী সুতরাং আন্দোলনে সবাই জামাতী। আবরার ফাহাদ সরকারবিরোধী সুতরাং তাকে মেরে ফেলা ঠিক আছে। চেনা চেনা লাগছে না?

ডেটলাইন- ৫ মে।

হেফাজতের পূর্ববর্তী সমাবেশ হয়েছিল ৫ এপ্রিল, ২০১৩ সালে। সেদিন তারা সমাবেশ করে চলে গিয়েছিল। সেদিন তারা শাহবাগে হামলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটা বিভিন্ন কারণে সফল হয় নি। শাহবাগের আন্দোলনকারীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। একজন এক্টিভিস্ট যিনি এখন বিদেশে বসে সকাল-বিকাল BAL ফেলাতেন, তিনিও এই প্রতিরোধের পক্ষে ছিল, এবং কেন আরো বেশি ছ্যাচা হল না সেটাও বলেছিল। সে সময়ে উনি একাত্তর টিভিতে গিয়ে সরকারের পক্ষে আর হেফাজত জামাতের বিপক্ষে কথা বলতো, তার ব্লগও আছে এসব ব্যাপারে।

আচ্ছা, তো, ৫ মে। সকাল থেকে ঢাকায় মানুষের ঢল নামে। আগের রাত থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন বাস কোম্পানী মানুষকে ঢাকার বর্ডার পর্যন্ত এনে নামিয়ে দেয়। তারা অবস্থান নিয়েছিল ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে। রাজনৈতিক সমাবেশের ক্ষেত্রে এইটা স্বাভাবিক, আগের রাতে, আর সকালে মানুষ ঢাকায় ঢোকে। হেফাজতের অবরোধ থেকেও মানুষ ঢাকায় ঢোকা শুরু করে।

সকালেই আওয়ামীলীগের অফিসে হামলা, ভাঙচুর (অবশ্য দুই পক্ষই অপর পক্ষকে দায়ী করেন হামলা শুরু জন্য) হয়, পুলিশ নিহত হয়, একজন নারী সাংবাদিককে লাঞ্চিত করা হয় তাদের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব পালনকালে। তাদের শ্লোগান ছিল "কুকুর বিড়াল মেরোনা, নাস্তিক পেলে ছেড়োনা!" আর "নাস্তিকরা ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালায়" মর্মে একটা ক্লিপও ভাইরাল হয়েছিল (ভাইরাল হইত না তখনও কিছুই, এই টার্মিনোলজি তখনও বাজারে আসে নাই) এছাড়াও পল্টন এলাকায় অবস্থিত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়। এই ছিল দিনের অবস্থা।

দেড়টার দিকে হেফাজতের মূল নেতারা শাপলা চত্বরে অবস্থান নিতে সক্ষম হলেও আশেপাশের এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর চলতে থাকে। নেতারা পুলিশকে জানায় যে বিকালে মোনাজাত করে তারা চলে যাবে। [কাদির কল্লোল, প্রথম আলো, ৫মে, ২০২৪] অর্থাৎ, দুপুর কিংবা বিকাল পর্যন্ত রাত্রিযাপনের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না তাদের। অন্যদিকে মতিঝিলের মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় নৈরাজ্য চলছিল, আর ক্ষণে ক্ষণে সেটা বিপদজনক হয়ে উঠছিল। (ফুড ফর থট- শাহবাগই কেন অধিকাংশ আন্দোলনের সূতিকাগার? কারণ লোকেশন! মতিঝিলে বসলে আপনারা সাস্টেইন করতে পারবেন না কারণ ঐটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা। তুলে দিবেই।)

সন্ধ্যার দিকে হেফাজতের আমীর শাহ আহমদ শফী শাপলা চত্বরে আসার কথা। তিনি লালবাগের মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু কোনো এক বিশেষ কারণে তিনি আসতে পারছিলেন না, বা আসতে চাচ্ছিলেন না। (রাতে বেগম জিয়ার বিবৃতি আসে বিএনপি কর্মীরা যেন হেফাজতকর্মীদের সর্বাত্মক সাহায্য করে।)

তাকে সমাবেশস্থলে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছিল সরকারের বিভিন্ন বাহিনী। শেষ পর্যন্ত তিনি রাত সাড়ে দশটার দিকে আসতে রাজি হয়েছেন, এবং লালবাগ মাদ্রাসা থেকে বেরও হয়েছেন, কিন্তু, রাস্তা থেকে শরীর খারাপের কথা বলে আবার লালবাগ মাদ্রাসায় ফিরে যান। অথচ কথা ছিল তিনি এসে মোনাজাত করিয়ে এই সমাবেশ শেষ করে দেবেন, এবং উপস্থিতরা চলে যাবেন। কিন্তু তা হল না। তিনি কেন এলেন না? আসতে চাচ্ছিলেন না কেন? এই দুইটা প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

যা হোক, আরেকটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে সেটা হচ্ছে হত্যাযজ্ঞ প্রচার করা নিয়ে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভিকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৫ মে বিকাল থেকে দিগন্ত টিভি অথবা ইসলামিক টিভির টিকারে/স্ক্রলে লেখা আসছিলো "Save Bangladeshi Muslims"।

৫ মে কী হয়েছিল যে বাংলাদেশে মুসলিম পরিচয়ের মানুষজন হুমকির মুখে ছিল? কাদের থেকে হুমকি? সংখ্যালঘুর সংখ্যালঘু, নাস্তিকদের থেকে? আমরা ভাই লুকায়া থাইকাই কূল পাইতেসিলাম না, গাঞ্জা খাবো...সর‍্যি বাংলাদেশের মুসলিমদের নিধন করবো কখন? তাহলে এই স্ক্রলকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? সংবাদপত্রের এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে সত্য প্রচারের‍, এটা তাদের মৌলিক অধিকার, কিন্তু মুসলিম খাতরে মে হে টাইপের প্রচারণা সর্বৈব অসত্য ছিল!

দিগন্ত টিভি বন্ধ হয় ভোর ৪টা ২মিনিটে। [Maria Salam, Dhaka Tribune, 6th May, 2013] শাপলা চত্বরের মিশন শেষ হয় ৪টায়। হত্যাযজ্ঞকে লুকাতেই যদি বন্ধ করা হয়ে থাকে, তবে মিশন শুরুর আগে কেন বন্ধ করে নি? অন্যান্য চ্যানেল (এনটিভি, আরটিভি, একুশে, বাংলাভিশন- প্রভৃতি সরকারবিরোধী মালিকানাধীন চ্যানেল) কীভাবে পুরো মিশন জুড়ে নিউজের কাভারেজের ফুটেজ আপলোড করেছে?

ইসলামিক টিভি বন্ধ হয় ২:৩০ এ [bdnews24, ৬ মে ২০১৩], অভিযান শুরু হয় ২:৪৫এ। ইসলামিক টিভি "হত্যাযজ্ঞ" দেখানোর সুযোগই পাওয়ার কথা না। দিগন্ত টিভিও একইভাবে দেখাতে পারার কথা না, কারণ সেখানে বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছিল, এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। অভিযান শেষে অন্যান্য চ্যানেলকে সাথে নিয়ে অভিযান চালানো লোকেরা বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেয়া লোকেদের বের করে দেয়, শুয়ে থাকা অনেককে গুতো দিলে তারা উঠে বসেছেন এমন ফুটেজও দেখেছি। সকাল বেলা মঞ্চের সামনে কফিনে মোড়ানো চারটি লাশ পাওয়া যায়। এই চারটি লাশ বিকালবেলায় নিয়ে আসা হয়েছিল আন্দোলনকে বেগবান করতে।

এবার হচ্ছে নিহতের সংখ্যা। হেফাজতের দাবি হাজার হাজার, সরকারের দাবি ১১, উপদেষ্টা আদিলুর রহমানের দাবি ৬০+। আচ্ছা, কোটাবিরোধী থেকে এক দফা আন্দোলনে নিহতের সংখ্যা কত? তার একটা তালিকা করা হয়েছে, এবং যে সময়ে হত্যাকাণ্ড হচ্ছিল তখন থেকেই করা হচ্ছে। প্রত্যেকটা মৃত্যু লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, লাশ কোথায় পাওয়া গেছে তা থেকে শুরু করে মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ/আঘাতের ধরণ সহ। সারাদেশের বিভিন্ন স্পটে হয়ে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের একটা ডিটেইলড ডেটাবেস আছে আমাদের হাতে।

হেফাজতেরটা কোথায়? গত ১১ বছরেও কি এই তালিকা প্রস্তুত করা যায় নি? কেন প্রস্তুত করা যায় নি? মাদ্রাসা থেকে আনা শিশু, শিক্ষকদের কেউ মারা গেলে বা নিখোঁজ থাকলে কি সেই তথ্য মাদ্রাসার রেজিস্টার থেকেই পাওয়া সম্ভব হত না? একটা মাদ্রাসা থেকে ১০জনের দল ঢাকায় আসলো, ৯জন ফিরতে পারলো, বাকি ১জন নিখোঁজ বা নিহত। সোজা হিসাব। কওমী মাদ্রাসার সেন্ট্রাল বডি হয়েও সেই তালিকা কেন প্রস্তুত করা গেল না?

দ্বিতীয়ত, "শহীদের রক্তের উপর দিয়ে শেখ হাসিনার কোনো আলোচনা হবে না" বলে যদি সরকারকে ফেলে দেয়া যায়, হেফাজতের মত একটা সুসংগঠিত সংগঠন এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলো না? কেন ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে হাছান মাহমুদকে (তৎকালীন বন ও পরিবেশমন্ত্রী, পরের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, এবং শেষ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী) আল্লামা শফী দোয়া দিলেন? কেন আল্লামা শফী গণভবনে দাওয়াত খাইতে গেলেন? রেলের জমি কেন গ্রহণ করলেন? কওমী মাদ্রাসার ছাত্র তার সন্তানতূল্য, তিনি কেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইলেন না তখন? বা বিচারের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকে রিজেক্ট করলেন না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ দিতে পারবেন?

আচ্ছা, ধরে নিলাম শফীকে coerce করেছে সরকার। কিন্তু অন্য নেতারা? বাবুনগরী? মামুনুল হক? কাশেমি? দ্যাট আদার ওয়ান? এরা সবাই কেন এখনো চুপ? তালিকা কেন নাই?

এখনকার সাথে ২০১৩ সালের পার্থক্য হচ্ছে সরকারের এবসলিউট মিডিয়া কন্ট্রোল ছিল ২০২৪ সালে, ২০১৩তে ছিল না। সরকারবিরোধীদের মালিকানাধীন মিডিয়া হাউজ ছিল তখন, বিএনপি সংসদে ছিল, সংসদে প্রাণবন্ত সেশন হইতো। বিএনপি তখন প্রধান বিরোধী দল সংসদে, রাজপথেও বিএনপি-জামাত ছিল, মিডিয়ায় বিএনপিপন্থী এবং ইন জেনারেল সরকারবিরোধী লোকেদের অবস্থান ছিল। আজকের যারা সরকারবিরোধী সাংবাদিক, যারা বিভিন্ন সময়ে চাকরিচ্যুত ও প্রাণ ভয়ে দেশ ছেড়েছেন, তাদের অনেকেই স্বপদে বহাল ছিলেন, এবং সরকারবিরোধী আলোচনা চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচারিত হইতো। আসিফ নজরুল, পিয়াস করিম, ফরহাদ মজহার- আন্দালিব পার্থ, এবং বিএনপির নেতারা বিভিন্ন টকশোতে গিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন দিনে রাতে।

২০২৪ সালের আওয়ামীলীগের যে পরিমান স্বৈরাচারী ছিল, যে পরিমান জুলুম করেছে, ২০১৩ সালে সে পরিমান জুলুম করতে পারে নি কারণ তখন তাদের বিরোধিতা করার মত ইন্সটিটিউট ছিল, তাদের এক্সপোজ করার মত অনেক মিডিয়া ছিল। এন্ড মোস্ট ইম্পর্টেন্ট অফ অল, আপনাদের সাহায্য করতে সাধারণ মানুষ নেমেছিল কারণ আপনারা ন্যায়ের দাবি নিয়ে এসেছিলেন। হেফাজতের পাশে ওভাবে সাধারণ মানুষ নামে নি কারণ ওদের দাবি অন্যায়, অভিলাষ রাজনৈতিক, এবং তাদের আচরণ ছিল ফ্যাসিস্ট।

আপনারা এই ঘটনার বিস্তারিত তদন্তের ডাক, দাবি জানাচ্ছেন খুবই ভাল। আমিও জানতে চাই সে রাতে কী ঘটেছিল। কিন্তু সে দাবি তুলে মিথ্যার মাধ্যমে পুরো ঘটনার ব্যাপারে একটা পাবলিক পারসেপশন বানিয়ে ফেলা তদন্তকে প্রভাবিত করবেই। জিয়াউল আহসানকে ধরা হয়েছে, তার থেকে তথ্য উদঘাটন করা হোক। তবে আগে থেকে একটা পারসেপশন বানিয়ে আশাহত হয়ে তদন্ত রিজেক্ট যেন না করেন তাই নিজের স্মৃতি থেকে যা মনে পরে লিখলাম।

Image by Al-Jazeera

No comments:

Powered by Blogger.